গভীর ভালোবাসা, গোপন সম্পর্ক, অপ্রকাশিত আবেগ—“তুমি শুধুই আমার” গল্পটি এমন এক পুরুষ ও নারীর ভালোবাসার কাহিনি যাদের সমাজ মানে না, কিন্তু হৃদয় মানে।
একজন বিবাহিত নারীর হৃদয়ে গোপনে জন্ম নেওয়া এক নিষিদ্ধ প্রেমের কাহিনি। সমাজের চোখ এড়িয়ে, তারা বাঁচতে চেয়েছিল শুধুই একে অপরের জন্য। এই গল্প বলবে এমন এক প্রেমের কথা যা শরীরের গভীরতা ছাড়িয়ে আত্মাকে ছুঁয়ে যায়।
কলকাতার এক শান্তপল্লীর ভেতর ছোট্ট একটা বাড়ি, ঠিক রাস্তার ধারের পুরোনো ছাদের ঘরটা। তানিয়ার বয়স তিরিশের কাছাকাছি, চোখে সবসময় একরাশ ক্লান্তি, ঠোঁটে নিঃশব্দ কিছু না-বলা কথা। সংসার করে, কিন্তু মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও। স্বামী অভিষেক ভালো মানুষ, কিন্তু সম্পর্কটায় কোথাও যেন ঘাটতি—একটা অদৃশ্য দূরত্ব।
তানিয়া একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, তখন ওর জীবনে এসেছিল আর্য। একই ক্লাস, একই স্বপ্ন, কিন্তু সময়ের ভুল বাঁকে হারিয়ে গিয়েছিল আর্য। তানিয়া সংসারে ঢুকেছিল, আর্য বাইরে।
বছর দশেক পর, এক বিকেলে তানিয়ার ইনবক্সে ভেসে এল একটা মেসেজ—
"তুমি ভালো আছো তানিয়া?"
আর্য!
প্রথমে উত্তর দেয়নি। কিন্তু রাতে, নিঃশব্দ ঘরে অভিষেক যখন ঘুমিয়ে, তখন তানিয়া লিখল—
"তোকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। এতদিন পর কেন?"
আর্য লিখল—
"হারানোর জন্য তো ভালোবাসা জন্মায় না, তাই না?"
এরপর শুরু হলো কথোপকথন। প্রতিদিন দুপুরের নিঃসঙ্গতায়, রাতের নীরবতায় তারা মেসেজ করত। ধীরে ধীরে সব কথা খুলে বলত তানিয়া—নিজের দাম্পত্যজীবনের শূন্যতা, ভালোবাসার অভাব।
একদিন আর্য বলল,
"আমি এখনো তোকে তেমনি ভালোবাসি, তুই কি পারিস না একটুও ফিরে তাকাতে?"
তানিয়া লিখল,
"চেষ্টা করিনি বলব না... কিন্তু তুই এসে সব এলোমেলো করে দিলি।"
এরপর দেখা হলো, এক ক্যাফেতে, কলেজের কাছে।
তানিয়া পরেছিল শাড়ি, স্নিগ্ধ মুখ। আর্য দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ, দৃষ্টি সরাতে পারছিল না।
সন্ধ্যার আলোয় কফির টেবিলে হাত ছুঁয়ে গেল, চোখে চোখ। আর্য বলল,
"তুই এখনও আমার সেই তানিয়া। তোকে ছাড়া কিছু ভাবিনি কখনো।"
তানিয়ার চোখে জল এসে গেল, বলল,
"আমি ভুলিনি তোকে, কিন্তু আমি এখন অন্য কারোর স্ত্রী।"
আর্য বলল,
"তুই কারো স্ত্রী হতে পারিস, কিন্তু মন তো কারো দাসী না। তোর হৃদয় এখনও আমার জন্যই কাঁদে।"
সেদিন রাতে তারা একসাথে অনেকটা সময় কাটাল, গল্পে, স্পর্শে, ভালোবাসায়।
তানিয়া অনুভব করল, আর্যর স্পর্শে এখনও কাঁপে ওর শরীর, হৃদয়।
তারপর একদিন, তারা একসাথে কাটাল একটা সন্ধ্যা। শহরের এক হোটেল রুমে।
নিভৃতে, আলো আধাঁরের ঘরে, মনের ভয় সরিয়ে রেখে তারা কাছে এল।
তানিয়া অনুভব করল যে শরীর নয়, আত্মা জড়িয়ে যাচ্ছে…
আর্য কাঁপা হাতে ওর চুলে আঙুল চালিয়ে বলল,
"এই ভালোবাসা যদি পাপ হয়, তবে আমি বারবার পাপ করতে রাজি।"
তারা চুপ করে একে অপরের পাশে শুয়ে থাকল, নিঃশব্দে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল, যেন রাতটা কাঁদছিল তাদের মতো।
কিন্তু এই সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ ছিল না।
তানিয়া একদিন লিখল,
"আমরা ভুল সময়ে একে অপরকে পেয়েছি, তাই তো? যদি দশ বছর আগে ফিরতে পারতাম..."
আর্য বলল,
"তখন হয়ত তুই আমার হয়ে থাকতি, কিন্তু এখন তুই আমার মনে থেকবি চিরকাল।"
তানিয়া জানত, সমাজ মানবে না তাদের ভালোবাসা।
কিন্তু একবার সে ভালোবেসেছিল, গভীরভাবে, এমনভাবে যা হয়ত সংসারেও পায়নি।
শেষবার দেখা হলো ট্রেন স্টেশনে। চোখে জল, হাতে চিঠি।
তানিয়া বলল,
"ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তবেই তো যাওয়া হয় না। তুই থাকিস আমার ভেতরেই, চিরকাল।"
আর্য কিছু বলল না। শুধু কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
**"তুই আমার শেষ প্রেম।"
স্টেশনের সেই বিদায়ের রাতের পর আর্য আর তানিয়ার মধ্যে সরাসরি কোনো যোগাযোগ ছিল না। তানিয়া ঘরে ফিরে গিয়েছিল, আবার অভিষেকের পাশে। হাসি মুখে, সংসারের ভেতরে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিল, যেন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু প্রতিদিন রাতে, যখন অভিষেক ঘুমিয়ে যেত, তখন একা বিছানায় শুয়ে চুপিচুপি চোখের কোণে গড়িয়ে যেত জল।
আর্য ঠিকই বুঝেছিল—তানিয়ার ভালোবাসা এখনও তার ভিতরে রয়েছে। তাই সে আর একবারও মেসেজ দেয়নি। ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তবে জোর করে কিছুই ফিরিয়ে আনা যায় না—এটা জানত সে।
তিন মাস পর
শীতের এক সন্ধ্যা। তানিয়া বইয়ের তাক গোছাতে গিয়ে খুঁজে পেল কলেজের সময়কার একটা পুরনো ডায়েরি। পাতার ভাঁজে আর্যর লেখা একটা কবিতা—
"ভালোবাসা যদি শুধু ছুঁয়ে যাওয়াই হয়, তবে কেন রয়ে যায় তার গন্ধ এই অব্দি?"
তানিয়ার বুক কেঁপে উঠল। পুরোনো অনুভূতিগুলো যেন আবার জেগে উঠল।
ও বুঝতে পারল—এই সম্পর্কটায় কোনো যৌনতা মুখ্য ছিল না, বরং ছিল অদ্ভুত এক আত্মিক টান।
যে টান সমাজ না মেনে নিলেও, মন বুঝে নেয়।
সেই রাতে তানিয়া আর ঘুমোতে পারেনি। ফোনটা বারবার হাতে তুলে আবার রেখে দিয়েছে। শেষমেশ আর্যকে লিখল—
"ভালোবাসা কি সত্যি কোনোদিন মরে যায়?"
আর্য তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল—
"না। শুধু চাপা পড়ে যায়, সময়ের ধুলোয়। কিন্তু তুই যদি বলিস, আমি আবার ফিরব সেই ধুলো সরিয়ে..."
এরপর আবার শুরু হলো তাদের গল্পের দ্বিতীয় অধ্যায়।
তানিয়া এখন আর পালিয়ে থাকতে চায় না।
তানিয়া বলল—
"এবার আমি সাহস করে বাঁচতে চাই। আমি তোকে শুধু রাতের প্রেমিক করে রাখতে চাই না আর।"
আর্য একটু চুপ করে থেকে বলল—
"তুই কি প্রস্তুত? সমাজ, পরিবার, সব কিছু ফেলে নতুন করে শুরু করার?"
তানিয়া বলল—
"ভালোবাসা যদি এতটা গভীর হয়, তাহলে তা সত্যি হওয়াটাও জরুরি। আমি আর অভিনয় করতে পারছি না।"
তানিয়া সিদ্ধান্ত নিল—সে অভিষেককে সব বলবে।
না কোনো লুকোচুরি, না আর কোনো চোরাগোপ্তা সম্পর্ক। কারণ ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তাহলে তার পরিচয় লুকিয়ে রাখা অপরাধ।
অভিষেক ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু সে তানিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝেছিল, ভালোবাসা বাধ্য করে না—সে আপনিই চলে যায় যেখানে সত্যিকারের টান থাকে।
তানিয়া তার সব দায়িত্ব শেষ করে, একদিন সকালে বেরিয়ে পড়ল। হাতে ছিল একটা চিঠি, আর্যর জন্য।
"আমি আসছি। এবার শুধু শরীর নয়, মন নিয়েও। আর যদি চাও, আমিও তোমার পাশে সারাজীবন থেকে যেতে চাই। ভালোবাসা হারানোর নয়, ফিরে পাওয়ার সাহস যদি থাকে, তবে বাকি জীবনটা আমাদের..."
বছরখানেক পর
একটা পাহাড়ি শহরে, ছোট্ট একটা কাঠের বাড়ি। বাড়ির সামনে বাগানে দু'জন মিলে গোলাপ গাছ লাগাচ্ছে।
তানিয়া আর আর্য।
তানিয়ার গায়ে হালকা শাল, হাতে কফির কাপ।
আর্য পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে।
তানিয়া মুচকি হেসে বলে,
"তুই জানিস, তোর ভালোবাসা আমায় সাহসী করে তুলেছে।"
আর্য চুপচাপ ওর কপালে চুমু খেয়ে বলে,
"ভালোবাসা তো এমনই, না? সে শুধু ঘর বাঁধে না, সে ভিতরটা ভরিয়ে দেয়।"