অন্তহীন অপেক্ষার পর মিলন
মায়া তখনো স্মৃতির ঘ্রাণে ভাসছিল। বৃষ্টির ধোঁয়াটে সকালে, ময়দানপাড়ের পুরনো বিশাল বটগাছের 아래 প্রথম দেখা হয়েছিল তাদের—মায়া আর অরুণের। তখন মায়ার হাতে ছিল কিছু ভুলে যাওয়া শপিং ব্যাগ, আর অরুণের হাতে ছিল ছাতা। দুজনেই প্রথমে একটু লজ্জায় এদিকওদিক চিনত, কেবল চোখ মেলে তাকিয়েই হাসি বিনিময় করল। বটগাছের ডালপালা যেন স্বাগত হিসাবে কোমল হাওয়া ছড়িয়ে দিচ্ছিল চারিদিকে।
“আপনার ছাতা… আমি তুলে দিতে পারি,” স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল অরুণ।
মায়া একটু লজ্জা পেয়ে হেসে বলল, “না, না—আমি তো…” কথা জমে না, তাই হালকা হাসি দিয়ে নিল ব্যাগগুলো।
এটা ছিল তাদের প্রথম কথোপকথন, কিন্তু মায়ার হৃদয়ে বাজলেও প্রথম সুরের মতো সুরভিত হলো। তারপর থেকে প্রতিদিনই দেখা হল—স্কুল থেকে ফেরা পথে, ময়দানের সেই বটগাছের তলায়। অরুণের সঙ্গেই মায়া অচেনা তানপুরার সুর শুনতে লাগল, মনে হতে লাগল জীবনের সবই এবার একত্রে হবে।
কিন্তু ভালোবাসার পথ সাধারণ হয় না—তার আগেই এসেছিল প্রথম ছাপোষা বাধা। অরুণের পরিবার অন্য শহরে চলে যাওয়ার খবর এল; পিতার বদলে যাওয়া পোস্টিংয়ের কারণে। মায়ার হৃদয় ভেঙে পড়ল। ঠিক সেই বিকেলে, বটগাছের তলায়…
“তুমি কি সত্যি চলে যাবে?” মায়ার চেয়ে চেয়ে কণ্ঠ আটকে গিয়েছিল।
অরুণ নীরবে তাকিয়ে থাকল, তারপর মৃদু কণ্ঠে বলল, “ওই শহরে আমি থাকব তো? তোমার থেকে দূরে? কিন্তু আমি চাই না… তোমাকে ছেড়ে যেতে।”
মায়ার গাটা কাঁপছিল। হাওয়া কেমন যেন নিভৃতে ঝরছিল, পাতা পড়ছিল চারিদিকে—মনে হচ্ছিল প্রতিটি পাতায় লেখা আছে বিদায়ের বেদনা।
“কিন্তু… ওখানে সবকিছু আলাদা হবে,” সে কণ্ঠ অস্থির হয়ে উঠল। “স্কুল, বন্ধুবান্ধব, আমার জীবন—আমি কীভাবে সামলাবো?”
অরুণ অচল হয়ে রইল, একটা অদ্ভুত স্বপ্ন ভেঙে তন্নতন্ন করে চেষ্টার মতো সে যেন খুঁজছিল মায়ার চোখে কোনো আশার রেখা।
মায়া চোখের কোণটা মুছল—“একটু সময় দাও,” সে বলল, “আমার মাথা একটু স্থির হতে চাই।”
ঊর্ধ্বে বটগাছের ডালপালা ছায়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ল, আর একটা অচেনা দমকা বায়ু বয়ে গেল। সেই বায়ু যেন বলল, ‘প্রেম জীবনের ঝড়ো আবহাওয়া, সেটা সামলাও।’
দু’জনেই চলে গেল শহরের ভিড়ের মধ্যে, কিন্তু সেই বিদায়্… মায়ার হৃদয়ে অমোঘ ছাপ ফেলল।
পরের কয়েকটা দিন মায়া ঘুম-জাগরণ, স্কুল-পড়াশোনা, মেয়েদের ছোট্ট আড্ডা—সবকিছুতেই অরুণের ছায়া ঘুরছিল। প্রতিটি ক্লাসরুমের জানালা, প্রতিটি গাছের মতোই মনে হচ্ছিল অরুণের না থাকা অচেনা লাগামহীন বেদনা ছেড়ে গেল।
এক সন্ধ্যায়, বাড়ি ফেরার পথে মায়া সিদ্ধান্ত নিল—একবার ফোন করে কথা বলবে। হাঁটতে হাঁটতে মোবাইলে অরুণের নাম দেখল, হৃদয়ে এক টান ইচ্ছে হল ‘কল’ চাপার।
“হ্যালো?”
“হ্যাঁ, আমি… আমি মায়া।”
“ওহ… কেমন আছ?” অরুণের কণ্ঠে বিরতি।
মায়ার গলায় কণ্ঠে আঁঁচের মতো অবসর—“ভালো না।”
“আমি তো চলে যাইনি ঠিকই… তোমার মনেই আছি।”
মায়া চুপ করে রইল। মিনিট পেরিয়ে গেল, তারপর ধীরে ধীরে বলে উঠল, “আমি দুঃখিত… আমিও… আমি তোমার সঙ্গ পাইনি, তাই রাগ করিনি।”
অরুণ শান্ত হয়ে বলল, “রাগ কোথায়? আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করি না।”
মায়া হঠাৎ রুদ্ধশ্বাস হয়ে বলল, “আমি ভয় পাই… যদি তুমি ওখানেও আমাকে ভুলে যাও?”
অরুণের উত্তর এলো শক্তি দিয়ে: “তুমি ভুলে যাওয়ার নয়—আমি শপথ করেছিলাম, যত দূরেই যাই, তোমার হাত ছেড়ে যাব না।”
মায়া চোখ ভিজে এল; ফোনের রশ্মিের আলোয় যেন তাঁর অশ্রু ঝিলমিল করে উঠল। সেই রাতে তারা কথা বলল দুই ঘণ্টা—স্কুলের, পরিবারের, ভবিষ্যতের স্বপ্ন আর অদৃশ্য বিষাদের মেঘের ওপারে আশার আলোয়।
তারপর অরুণের যাত্রা শুরু হল। গাড়িতে করে তিনি এক সকালে বেরিয়ে গেলেন, মর্মর বিমানবন্দর হয়ে পথে সহস্র দিগন্ত অতিক্রম করলেন। মায়া চালক বন্ধুদের নিয়ে এসে দেখা করল—গেটের দূরতম প্রান্তে আছেন অরুণ। তাদের চোখে মিলল এক অদ্ভুত উষ্ণতা—বিদায়ের দৃশ্যগুলোও যেন এক ধরনের প্রেমের অঙ্গীকার বলে মনে হচ্ছিল।
অরুণ ভাঙা গলায় বলল, “মায়া, ওখানে পৌঁছেই কল দেব। প্রতিদিন, ঠিক ঠিক এই সময়ে।”
মায়ার গলা কেঁপে উঠল, “আমি অপেক্ষা করব।”
তারপর ধীরে ধীরে ছুঁয়ে দিলেন অরুণের হাত, বিস্মৃতির মতো শিহরণ নেমে এল দু’জনের দেহে।
পাখির কলপ্রায় আওয়াজে ঢেকে গেল বিদায়ী মুহূর্ত।
নতুন শহরে অরুণের দিন শুরু হল। বিশ্ববিদ্যালয়, লাইব্রেরি, নতুন বন্ধুরা—সবকিছুই নতুন, কিন্তু মনের আঙিনায় অরুণের মাথায় ঘুরছিল শুধুই মায়ার কথাগুলো। সে দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ঠিক সময়ে ফোন করত, মায়া ফোন দিত—কোনো দিন মেসেজ, কোনো দিন ভিডিও কল।
কিন্তু ভারী পড়ল দূরত্বের বোঝা। একবার ফোন সিগন্যাল গেল, কথা বন্ধ হয়ে গেল—অরুণ প্রচণ্ড বেদনা নিয়ে ফোন রাখল। পরেরদিন মিসড কল দেখতে পেয়ে মায়া ওই সময়ে ব্যস্ত ক্লাসে ছিল, ফোন ধরতে না পারায় মায়া দুঃখে বারবার কল করলেও আর্টিকুলার সিগন্যাল দুর্বল।
এক সপ্তাহ বন্ধ। দুই সপ্তাহ বন্ধ। এক মাস বন্ধ।
মায়ার গলা ভেঙে গেল—প্রতিদিন বসে চোখে চেয়ে থাকত মুঠোফোনের স্ক্রিন, কোনো সিগন্যাল কি আসছে? ফোন কী বাজছে? তার ভেতর আনন্দ-আকুলতা আর বিষণ্ণতার লড়াই চলছিল, ঠিক যেন একা-একাকী বৃষ্টির মতো থেমে গেলাছে সময়।
অরুণও হারিয়ে গিয়েছিল নন-লাইনে। নতুন জীবন যেন তাকে গ্রাস করে নিয়ে গেছে; ধীরে ধীরে মায়ার স্মৃতিটা দূর থেকে নরমালো হয়ে আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছিল।
মাঝে মাঝে সে ক্লাসে শোনতো মেয়েদের গল্প—কেউ বলতো, “তুমি কি ওর সঙ্গে ফোন চালু রাখছ?” কেউ বলতো, “দূরত্বে ভালোবাসা বাঁচে না।”
অরুণের মন ভারাক্রান্ত—সে নিজে ভাবছিল, “দূরত্ব… ভালোবাসার নাকি সমুদ্র?” সে শুধু জানত, মায়াকে ভুলতে চাই না, কিন্ত অবস্থা এমন, যেন কোনো অদৃশ্য বিচ্ছেদের বায়ু তার চারপাশে পড়ছে।
এক বিকেলে, অরুণ লাইব্রেরিতে পড়ছিল, মন আর চোখ কোনদিকে লক্ষ্য রাখছে বুঝত না। ফোন হঠাৎ টনটন করে উঠল—মায়ার নাম! অরুণের হৃদয়ে অজানা স্পন্দন—“বল, তুমি কি ঠিক আছ?” অরুণ জিজ্ঞেস করল।
কিন্তু মায়ার কণ্ঠে ভয়, বিষণœে মিশে গিয়েছিল—“আমি… আমি… আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না।”
অরুণ স্তম্ভিত—“অপেক্ষা? তুমি?”
“হ্যাঁ। তুমি যদি সত্যিই… আমাকে ভালোবাসো, তাহলে এসো… এখানে… না হলে আমায় আর রোজ প্রতীক্ষায় কাটতে হবে না।”
অরুণের হৃদয় কেঁপে উঠল। এসো—মায়া এসে বলে দিয়েছে; আবারও সেই বেদনার সুঁয় পার হয়ে যেতে হবে? কিন্তু… সেখানে কতটা ঝুঁকি লুকিয়ে আছে!
মায়া মৃদু করুণ চোখে বলল, “আমি তোমায় চাই—কোনো দূরত্বেই ঠেকবে না। আমি অপেক্ষা করছি এযাত্রা আর ভুলব না।”
অরুণ কল কেটে দিল। লাইব্রেরির নির্জন কক্ষে সে বসে আবেগে চোখ ভিজিয়ে বলল, “আমি ভাবিনি… এতটা কাছে আসবে তুমি।”
তারপর রাতের অন্ধকারে অরুণ অপেক্ষা করল—পরের দিন বেলা বারোটায় ফ্লাইট ধরে শহর ছেড়ে চলে আসার জন্য।
ফেরার দিন, অরুণ যখন বিমানবন্দরে নামল, মায়ার ফোন আবার টন করল—“আমি স্টেশনেই আছি।”
অরুণ দৌড়ে এলো টার্মিনালে, মায়ার চোখের সামনে ধুন্ধুমার আলো আর অচেনা ভিড়। হঠাৎ সামনে আরেকটু আলোকবর্তিকা টিউলিফুলর মতো উজ্জ্বল হল—মায়া!
মায়া হাত ডানা ছাড়িয়ে ফেলে, অরুণ ছুটে গিয়ে ধরে নিল তার হাত। দুজনেই এতটাই নীরব, কেন যেন শব্দগুলো বলে ফেলল ভয়ানক নিঃশব্দতা—‘আমি ফিরে এসেছি’, ‘আমি ভালো বাসি তোমায়’।
মায়ার চোখ ভিজে এলো, “তুমি আসলে… এসেছ?”
অরুণ স্বপ্নের মতো হাসি ছড়িয়ে বলল, “কোথাও গেলে, তুমি ভেবো না—আমি ফিরবেই।”
ওই মূহূর্তে দু’জনের মন জুড়ে উঠল একটা শান্ত পুনর্মিলন—দীর্ঘ বিচ্ছেদের শেষে গভীর স্বীকারোক্তি, ভুল-ত্রুটির ভুলিয়ে যাওয়া, ভালবাসার অটল নির্ধারণ।
এর পরের দিনগুলো আরও মধুর হয়ে উঠল। তারা হাত ধরে হাঁটল নদীর ধারে, পুরনো পার্কের বেঞ্চে বসে জীবন আর প্রেম নিয়ে আলোচনা করল। কখনো হেসে, কখনো চোখ ভিজিয়ে, কখনো মৃদু বিষণœে মনে রেখল কতটা বেদনা পেরিয়ে এসেছে তারা।
মায়া ভাবল, “যদি সে না আসত?”
অরুণ ভাবল, “যদি আমি না ফেরত আসত?”
দু’জনেই জানত—ভালোবাসা কোনোকালেই সহজ নয়। দূরত্ব, সময়, বাধা—সবকিছুই আছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো বিশ্বাস আর ইচ্ছে। তারা সিদ্ধান্ত নিল, আর কখনো ফোন বন্ধ করবে না, আর কখনো অপেক্ষায় ছেড়ে দেবে না একে অন্যকে।
কিছু মাস পরে, এক বিকেলে অরুণ মায়াকে প্রস্তাব দিল—“চলো,” সে বলল, “এই শহরই হোক আমাদের নতুন ঠিকানা।”
মায়া নিজে থেকে বলল, “আমি প্রস্তুত—তোমার কাছে, তোমার নদীর তীরে।”
নদীর ঢেউ পরশ করল তাদের পায়। আকাশে লাল সূর্য ডুবে আসছিল—মায়ার কান্নার মতো উজ্জ্বল ছবি আঁকা হল আকাশে। অরুণ হাত বাড়িয়ে মায়ার হাত ধরল, আর নীরবে বলল, “এবার আর কখনো না ছেড়ে যাব।”
মায়া মৃদু হেসে বলল, “আমিও… আর কখনো না ভেঙে.”
তাদের হৃদয়ের সুর লয়ে বাঁধল চিরকালীন গান—যেখানে দূরত্বের অন্ধকারও প্রেমের আলো ছেড়ে জলাতে পারে না।